md salim mukhomukhe

এক-তৃতীয়াংশ আসনে জিতবে বাম-কংগ্রেস জোট- মুখোমুখি মহম্মদ সেলিম

Published On:
লেটেস্ট আপডেট সবার আগে Join Now

দেবব্রত মণ্ডল~ মুর্শিদাবাদ, যে শহরের গায়ে লেগে আছে ইতিহাসের গন্ধ। এই শহরের মতিঝিল, লালবাগ, হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ, ভাগীরথী বাংলার বহু ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। চাঁদনি রাতে ভাগীরথীর তীরে একাকী বসে থাকলে আজও শোনা যায় এই শহরের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। সেসব বহুদিন আগের কথা, ঢাকা থেকে আওরঙ্গজেবের দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ চলে এসেছিলেন মুকসুদাবাদে। পরবর্তী সময়ে তার নাম থেকেই এই শহরের নাম হয় মুর্শিদাবাদ। তারপর কত দিন কেটে গেছে, মুর্শিদাবাদকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে বাংলার রাজনীতি। এতদিন পরেও মুর্শিদাবাদ তার বুকে সযত্নে লালন করে চলেছে সেসব ইতিহাসকে। যে ইতিহাস কখনও ইংরেজদের বিরুদ্ধে হার না মানা যুদ্ধের কথা বলে, বলে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শুধু কি তাই? ওই যে বলে না মুদ্রার উল্টোপিঠও যে আছে। সেকারনেই মুর্শিদাবাদ শহরের বুকের ভিতর কান পাতলে শোনা যায় বিশ্বাসঘাতকতার গল্প।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে মীরজাফর বাংলার বুকে যে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করেছিলেন সেই বিশ্বাসঘাতকতার নিদর্শন কী আজও ফল্গু নদীর মতো বয়ে চলেছে মুর্শিদাবাদের অন্তরে? এবারের লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদের সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের দাবি অন্তত তেমনই। তার বক্তব্য, ‘ মানুষ এখানে ভোট দিয়ে তৃণমূলকে জিতিয়ে শাসক দলের প্রকৃত স্বরূপটা বুঝতে পেরেছে। আমি ওখানে ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য।’ মুর্শিদাবাদে ভোট শেষ। ভোটের দিন প্রতিটি বুথে রীতিমত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বছর ৬৬-এর এই যুবক। বিরোধী দলের বিক্ষোভ, ধাক্কাধাক্কি, জুলুমবাজির চেষ্টা কোনটাই পিছু হটাতে পারেনি তাকে। নিজের কেন্দ্রে ভোট শেষ, তারপরেও নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই সেলিমের। অন্যান্য প্রার্থীদের প্রচারের কাজে ছুটে বেড়াচ্ছেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে। তার মধ্যেই জি এন ই বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ধরা দিলেন মহম্মদ সেলিম। সেলিমের সঙ্গে কথপোকথনে একদিকে যেমন উঠে এল নির্বাচনী বন্ড, সিপিএমের বৃদ্ধতন্ত্র, আইএসএফের সঙ্গে জোটের প্রসঙ্গ তেমনি উঠে এল বামপন্থার পুনর্জাগরণের প্রশ্নও।

প্রশ্ন: সৃজন, প্রতীকউর, দীপ্সিতার মতো তরুণ মুখকে এবার লোকসভা ভোটে প্রার্থী করেছে সিপিএম। সিপিএমকে একসময় বৃদ্ধদের দল বলে কটাক্ষ করা হত। সেক্ষেত্রে এত তরুণ মুখের মাঝে ৬০ পেরিয়ে নিজেকে বেমানান মনে হয় না?

সেলিম: না, তা কেন মনে হবে? দল যাদের যোগ্য বলে মনে করেছে তাদের প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রার্থিতালিকা দেখলেই বোঝা যাবে এই তালিকা তৈরি হয়েছে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যকে মাথায় রেখে। সুতরাং নিজেকে বেমানান মনে হওয়ার কোন কারণ নেই।

প্রশ্ন: জ্যোতি বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রর পরে দলের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছেন আপনি। ভোটের লড়াই কতটা কঠিন ছিল? বিভিন্ন সমীক্ষা কিন্তু বলছে জিতবেন আপনি। আপনি নিজে কতটা আত্মবিশ্বাসী?

সেলিম: দেখুন প্রশ্নটা দলের রাজ্য সম্পাদক বলে নয়। ভোটের লড়াই সবসময় কঠিন। কিন্তু বামপন্থীরা লড়তে ভয় পায় না। অন্য আর পাঁচটা রাজনৈতিক দল যখন ইস্যুভিত্তিক রাজনীতিতে ব্যস্ত সেইসময় আমরা মানুষের রুটি, রুজির কথা বলছি। মানুষ আমাদের গ্রহণ করছেন, তারা বুঝছেন তাদের পাশে আছে বামপন্থীরাই। সুতরাং লড়াইয়ে আমরা কোন অংশে পিছিয়ে নেই। আর প্রচারে বলুন বা জনসভায় যা সমর্থন চোখে পড়ছে তাতে এর প্রভাব ভোটবাক্সতে পড়তে বাধ্য। তাছাড়াও তিনদফা ভোটের পর আমাদের কাছে যা রিপোর্ট আসছে তাতে দেশে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূলের হাওয়া পাতলা হয়ে এসেছে। মানুষ যদি অবাধে ভোট দিতে পারে তাহলে বাম – কংগ্রেস জোট এক তৃতীয়াংশ আসন পাবে।

প্রশ্ন: ইন্ডিয়া জোটকে আপনারা সমর্থন করেছেন। দেশের মসনদ থেকে বিজেপিকে সরানোর জন্য তৃণমূলের হাত ধরতে হল? নীচুতলার কর্মীরা এই রণনীতি কতটা গ্রহণ করেছেন? যারা সংগঠন তৈরি করেন তারা প্রতিদিন তো শাসকদলের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছেন। তারা আপনাদের এই সিদ্ধান্ত কেন মেনে নেবেন?

সেলিম: দেখুন এইসব পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে কোন লাভ নেই। সাধারণ মানুষ থেকে নীচুতলার কর্মীরা না চাইলে এই জোট হত না। ইন্ডিয়া জোট শুধু দলের মুখপাত্রদের না, তলাপাত্রদের। বিজেপিকে হারানোর জন্য দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের এক হওয়া প্রয়োজন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছেন? উনি তো বলেই দিয়েছেন উনি বাইরে থেকে এনডিএ জোটকে সমর্থন করবেন। তার মানে মমতা ইন্ডিয়া জোটে নেই, সুতরাং তৃণমূলের হাত ধরার কোন প্রশ্ন নেই।

আরও পড়ুনঃ নির্বাচন হোক রোটি-কাপড়া-মকানের দাবিকে সামনে রেখে, মুখোমুখি – প্রতীকউর রহমান

প্রশ্ন: বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে গোটা বিশ্বে বর্তমান সময়ে ডানপন্থী সরকারের রমরমা চলছে। ভারত, ইজরায়েল, আমেরিকার মতো দেশে ক্ষমতায় রয়েছে ডানপন্থী সরকার। তবে কী বামপন্থী রাজনীতি ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে?

সেলিম: দেখুন ক্ষমতায় থাকাটা সবসময় বড় বিষয় না। ক্ষমতায় না থাকলেও বামপন্থীরা লড়াইয়ে থাকে। গত তিন দশক ধরে গোটা পৃথিবীতে ডানপন্থী রাজনীতির যে উত্থান সেটা কিন্তু অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। মানুষ বুঝতে শিখেছে সীমাহীন বেকারত্ব, দুর্নীতি থেকে বাঁচতে বামপন্থা একমাত্র বিকল্প।

প্রশ্ন: SUCI- এর রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য অভিযোগ করেছেন, আপনারা নির্বাচনী বন্ড থেকে টাকা না নিলেও বহু কর্পোরেট হাউস থেকে চাঁদা নিয়েছেন। যারা কৃষকদের ভাতের কথা বলেন, সমকাজে সমবেতনের কথা বলেন তারাই যদি কর্পোরেট সংস্থার কাছে হাত পাতে তাহলে দ্বিচারিতা হয় না?

সেলিম: চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের কথার কোন গুরুত্ব নেই। উনি ফুটেজ পান সিপিএমকে গালাগালি করে। বামপন্থীরা শুধু নির্বাচনী বন্ডের সাহায্য নেয়নি তা নয়, এর বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেছে এবং জিতে ফিরেছে। চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য দেখান কোন কর্পোরেট হাউস থেকে আমরা টাকা নিয়েছি। উনি এদিকে সিপিএমকে গালাগালি করছেন আর এসইউসিআই তৃণমূলের টাকায় ব্রিগেড করছে।

প্রশ্ন: দীর্ঘ টালবাহানার পরেও আইএসএফ আপনাদের সঙ্গে জোট করেনি। উল্টে আপনারা যেসব কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছেন তারমধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে আইএসএফ প্রার্থী দিয়েছে। এই ভোট কাটাকাটিতে তৃণমূল, বিজেপির লাভ হবে না?

সেলিম: যা চণ্ডীদাস তাই নৌশাদ। ওরা নিজেদের সুবিধা বুঝে সিপিএমের সঙ্গে ছিলেন তখন মিডিয়ার ফুটেজ পেয়েছেন আবার এখন সিপিএমকে গালাগালি করছেন তখনও ফুটেজ পাচ্ছেন। সবটাই প্রচারসর্বস্বতা। জোট যখন হয়নি তখন আমাদের লড়াই আমাদের নিজেদেরকেই লড়তে হবে।

মুর্শিদাবাদ। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এই শহরে ফের একবার ইতিহাস লিখতে পারবেন সেলিম? একসময় সাধারণ মানুষ মুর্শিদাবাদ বলতে বুঝতেন বাম – কংগ্রেস হাড্ডাহাড্ডি লড়াইকে। যেখানে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি ছিল না। ২০১৯ সাল থেকে খেলা ঘুরে যায়। সেবার জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী আবু তাহের খান? বাম প্রার্থী বদরুজ্জোহার ভোট নেমে গিয়েছিল মাত্র ১২ শতাংশে। এবার কি ফের একবার মহাকালের রথের চাকা পাক খাবে? লাল পতাকার স্বপ্নকে বুকে নিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে হাজার হাজার বাম কর্মী-সমর্থক। মুর্শিদাবাদ ধর্মের দলাদলি চাই না, চাই না ঘরের ছেলে অভাবের কারণে পরিণত হোক পরিযায়ী শ্রমিকে। মুর্শিদাবাদ চাই বেঁধে বেঁধে থাকতে, চাই বাণিজ্য আর শিক্ষার সম্প্রসারণ। যে শিক্ষা দিনের শেষে দুমুঠো ভাতের যোগান দিতে পারে। সেলিম এতদিন এই স্বপ্নই তো ফেরি করে বেড়িয়েছেন। তিনি পারবেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হয়ে উঠতে? উত্তর মিলবে ৪ জুন।

Latest Posts